সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:১৯ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি বেশিরভাগ সময়ই দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে রেখেছে সুস্পষ্ট ছাপ। এই সংসদ শুধু ছাত্রজীবনের নেতৃত্বের অনুশীলন নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব তৈরির কারিগরও বটে। ডাকসুর ইতিহাসে এ পর্যন্ত মোট ৩৭ বার নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে ২৯ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে মাত্র আটবার ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন হয়েছে। অথচ ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতি বছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও গত সাড়ে তিন দশকে এর ব্যত্যয় ঘটেছে বারবার।
সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। এবার দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে থাকা এ সংসদ আবারও সচল হতে চলেছে। ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এটি হবে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতনের পর দেশের ছাত্ররাজনীতিতে প্রথম বৃহৎ নির্বাচনি আয়োজন।
এবারের ডাকসু নির্বাচন নিছক একটি প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে এক সম্ভাবনাময় বাঁক। ডাকসুর ইতিহাসে নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ও প্রভাব সবসময় সীমিত পরিসরে থাকলেও এবার সেই চিত্র পাল্টে দেওয়ার আভাস দিচ্ছে নারী ভোটাররা। এবার ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নারী শিক্ষার্থীরা- যাদের ভোটের পরিমাণ ও প্রভাব আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার আছেন ১৮ হাজার ৯০২ জন, যা মোট ভোটারের প্রায় ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সংখ্যাই জানান দিচ্ছে যে, নারী শিক্ষার্থীদের ভোট এবার নির্বাচনের ফল নির্ধারণে হয়ে উঠতে পারে প্রধান শক্তি। বিশেষ করে রোকেয়া হলে ৫ হাজার ৬৪১ জন, শামসুন নাহার হলে ৪ হাজার ৮৪ জন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ২ হাজার ১০৩ জন, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৪ হাজার ৪৩৪ জন ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ২ হাজার ৬৪০ জন ভোটার- এই পাঁচ হলেই গড়ে উঠেছে নারী ভোটের এক বিশাল ভাণ্ডার। সংখ্যার বিচারে এ ভোট উপেক্ষা করার সুযোগ নেই কারও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নারী শিক্ষার্থীদের এ বিপুল ভোটাধিকার প্রয়োগ নির্বাচনের ফলাফলকে কতটা পাল্টে দিতে পারবে? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নারী ভোটাররা সচেতন, দায়িত্বশীল ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। তারা তাদের ভোটের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য ও নারীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস উপহার দিতে পারবে, এরকম নেতৃত্ব বেছে নেবেন। নারী শিক্ষার্থীরা যদি তাদের ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নেন, তবে শুধু ডাকসুই নয়, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে। তাদের এ ভোট নেতৃত্বের চরিত্র, রাজনীতির ভাষ্য ও গণতান্ত্রিক চর্চার ধরনকে পাল্টে দেবে।
এবার ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল-নেতৃত্বাধীন প্যানেল, ছাত্রশিবির-নেতৃত্বাধীন ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, কাদের-বাকের নেতৃত্বাধীন ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ ইমি ও বসুর নেতৃত্বাধীন বামপন্থি ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, সাবেক এনসিপি নেতা মাহিনের নেতৃত্বে ‘ডিইউ ফার্স্ট’, উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র প্যানেল, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন নেতৃত্বাধীন প্যানেল, ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’সহ আরও একাধিক প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। সব প্যানেলেরই এবার মূল টার্গেট নারী ভোটারদের ভোট, কারণ ভোটের সকল সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে নারী শিক্ষার্থীদের ভোট।
প্রায় অর্ধেক ভোটার নারী হওয়ায় কোনো প্রার্থীই আর তাদের ভোটকে অবহেলা করছেন না। প্রার্থীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। জয় করার চেষ্টা করছেন নারী ভোটারদের মন।
তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের দিন নারী শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্য ও নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই হবে প্রধান শর্ত। একইসঙ্গে প্রার্থীদেরও উপলব্ধি করতে হবে- নারী ভোটকে শুধু সংখ্যা হিসেবে গণনা করলে চলবে না, এটি ভবিষ্যতের রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণের এক গভীর বার্তা।
অতএব, সন্দেহ নেই- নারী শিক্ষার্থীদের ভোটই বদলে দেবে ডাকসুর ইতিহাস। এই ভোটের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে সমতা, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বের এক নতুন অধ্যায়।
লেখক : অনলাইন ইনচার্জ
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ